বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ‘মাছ চাষ’ এক বিপ্লবের নাম। এটি বদলে দিয়েছে এ দেশের কৃষি অর্থনীতির চিত্রপট। মাছ চাষে পৃথিবীতে পঞ্চম স্থান দখল করা বাংলাদেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৫৮ শতাংশ পূরণ হচ্ছে মাছ দিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সারা দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ৪২ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন। ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের দৈনিক খাদ্য চাহিদার ৬২.৫৮ গ্রাম মাছের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
একটা সময় মাছ চাষের ক্যাম্পেইন করেছি। মনে পড়ছে, আশির দশকের শেষ ভাগেও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোই ছিল মাছের মূল উৎস। যখন গেরস্থ কৃষককে তার পুকুর দেখিয়ে বলতাম, আপনি এ পুকুরটাতে মাছ চাষ করতে পারেন। তখন তারা অবাক হয়ে বলত, চাষ তো হয় ধান-পাটের, মাছের আবার চাষ কী? বাড়ির পাশের পুকুরটি ব্যবহার করত গোসল আর কাপড়-ধোয়ার কাজে। কিন্তু এ পুকুরটিই যে তার পারিবারিক মাছের চাহিদা মিটিয়ে আয়ের বড় একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে- তা ছিল তার চিন্তার বাইরে। সরকারি উদ্যোগ ও টেলিভিশন প্রচারে মাছ চাষ ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। তখন কৃষককে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে তৈরি করেছিলাম ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ শিরোনামে টেলিভিশন ফিলার। আজ সেই এক হাকিম আলী থেকে লাখ লাখ হাকিম আলী মাছ চাষে যুক্ত।
প্রিয় পাঠক! আমার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত তরুণরা যাতে চাকরি নামের সোনার হরিণের জন্য ছুটে ব্যর্থ ও হতাশ না হয়ে গ্রামে গ্রামে ফিরে গিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে উদ্যোক্তা। আজ তাই-ই হয়েছে। লক্ষ্য করবেন, শতকরা ৯৫ ভাগ খামার মালিকই শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা, যারা মাছ চাষের মাধ্যমে আমাদের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে কাজ করছে।
৪০ বছরে পাল্টে গেছে মাছ চাষের আদ্যোপান্ত। দেশের এমন কোনো জলাধার এমনকি ডোবা পর্যন্ত নেই, যেখানে মাছ চাষ হয় না। এখন বলাই যায়, এ দেশের পুকুরভরা মাছ। সেদিন খুব সম্ভব বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা ‘পুকুরভরা মাছের’ পাশাপাশি বলব, এ দেশের ‘ঘরভরা মাছ’। দিন দিন ঘরের ভিতর মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অসংখ্য উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাছ চাষের সঙ্গে। মাছের উৎপাদনে নতুন বিপ্লবের আভাস পাচ্ছি। কৃষি যেমন আবাদি খেত থেকে চলে যাচ্ছে গ্রিন হাউসে, একইভাবে মাছ চাষও পৌঁছে যাচ্ছে ঘরের মধ্যে, ইনডোর অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেমে। পাঠক! আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, প্রাকৃতিক পুকুর ছাড়াও মাছ চাষের এই অভিনব পদ্ধতি প্রথমবার তুলে ধরেছিলাম বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বিসিএসআইআরের একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র থেকে। এরপর বিভিন্ন প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি এ প্রযুক্তি নিয়ে অন্যান্য দেশ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষক অনন্য এই কারণে যে, তাদের কোনো টেকনিক বা কৌশল দেখিয়ে দিলে তারা নিজস্ব মেধা ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি দিয়ে নিজের মতো করে সাফল্যকে তৈরি করে নেন। যে কারণে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর সূচনা সংগীতে আমি যুক্ত করেছিলাম একটি লাইনে ‘বাংলাদেশের কৃষক হলো এই, একটুখানি ধরিয়ে দিলে খেই, অসাধ্যকে সাধ্য করে চোখের নিমিষেই’। এমনই একজন রাজশাহীর কাটাখালী এলাকার ইমদাদুল হক। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ সালে। তখন তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন জাতের ছাগল, ভেড়া ও গরু লালন-পালনের। পাশাপাশি পুকুরে মাছ চাষ করতেন। কিন্তু তার সাফল্যে বিপর্যয় নেমে আসে সে বছর বন্যায় যখন তার পুকুরগুলো ভেসে যায়। বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন ইমদাদুল হক। ভেড়া-ছাগল ও গরু লালন-পালনের প্রকল্পটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। দিশাহারা হয়ে যান। কী করবেন, কীভাবে উঠে দাঁড়াবেন? জীবিকার তাগিদে কৃষি ছেড়ে অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছেন তিনি। কিন্তু কৃষির প্রতি টান তার রক্তের ভিতর। হৃদয়ে মাটি ও মানুষে প্রচারিত ঘরের ভিতর মাছ চাষের প্রতিবেদনটি দেখে তার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু আরএএস সিস্টেমে মাছ চাষ করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন তা তার ছিল না। দমে যাননি ইমদাদুল। ইউটিউবে আরএএস সিস্টেমে মাছ চাষের বিভিন্ন ভিডিও দেখে দেখে আধুনিক কলাকৌশলের সঙ্গে নিজস্ব চিন্তাভাবনা যোগ করে তৈরি করেন কম খরচে রিসাইক্লিং অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতির অবকাঠামো। অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিতে মাছ চাষে এসে পেছনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান তিনি। মাত্র ৩ হাজার ৭০০ টাকার বিনিয়োগে ১ হাজার ৫০০ লিটার পানিতে মাত্র ৫০০ পিস তেলাপিয়া আবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নতুন পথচলা। তিন বছরে তার মাছের সেই কুটিরশিল্প ছোটখাটো মাছের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এখন তিনি ছোট-বড় মিলে ৩৪টি সিমেন্টের ট্যাংক, ২২টি প্লাস্টিক ড্রামে প্রায় ২ লাখ লিটার পানিতে উৎপাদন করছেন শিং, মাগুর, কই ও শৌখিন রঙিন বিদেশি মাছ; যা দ্রুতই পাল্টে দিয়েছে মাছ উৎপাদনের হিসাব-নিকাশ।
আরএএসের পাশাপাশি যুক্ত করেছেন মাছ চাষের আরেক আধুনিক কৌশল বায়োফ্লক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে মাছের ব্যবহৃত খাবারের অবশিষ্টাংশ বা নোংরা আবর্জনাকে রিসাইক্লিং করে বিশেষ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা রূপান্তরিত হয়ে আবারও মাছের উপযোগী খাবারে পরিণত হয়। এতে উৎপাদন খরচ আরও কমে যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় করেছেন মাত্র ৮ লাখ টাকা। সেখানে প্রতি চার মাসে দেড় লাখ টাকা লগ্নি করে আয় আসছে ৫ লাখ টাকার ওপরে। এ থেকেই মাসে গড় আয় ১ লাখ টাকা।
সাদা মাছের হিসাব তো গেল। রংপুরের মৃদুল রহমান ও সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজীর রঙিন মাছের প্রতিবেদন দেখে ইমদাদুল হক অনুপ্রাণিত হয়ে ঝুঁকলেন শৌখিন মাছ চাষে। প্রায় ২৫ রকমের রঙিন শৌখিন মাছ চাষ করছেন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে। এতে উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে, ফলে লাভ হচ্ছে বেশি।
ইমদাদুল জানান, আরএএস বা বায়োফ্লকের মাধ্যমে পুকুরের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি মাছ চাষ সম্ভব। তিনি দুটি ট্যাংকে প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার শিং মাছ উৎপাদন করছেন; যা উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই পরিমাণ মাছ উৎপাদনে লাগত কমপক্ষে ২ বিঘা আয়তনের জলাধার।
ইমদাদুল মাত্র ১২ ফুট বাই ১৬ ফুট আয়তনের সিমেন্টের পাকা জলায়তনে চাষ করছেন রঙিন মাছের রেণু। জানালেন, মাত্র এতটুকু জায়গায় ঠিকঠাকমতো চাষ করলে চার মাসে ১ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। দুঃসময় কাটিয়ে নিজস্ব মেধা আর একাগ্রতা দিয়ে ইমদাদুল জয় করেছেন সাফল্যকে। মিলেছে অর্থনৈতিক মুক্তি, পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন আত্মবিশ^াসী। এলাকাবাসীর কাছেও তিনি হয়ে উঠেছেন ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাছ চাষের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
ইমদাদুল হকের কাছে এখন সামগ্রিক জীবনের উন্নতির প্রশ্নে সন্ধান মিলেছে শ্রম, নিষ্ঠা আর বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজের মতো করে আধুনিক মাছ চাষের এই অবকাঠামোকে রপ্ত করা। তার কাছে এখন আগামীর কৃষি মানে প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যিক কৃষি। সেখানেই তিনি বিনিয়োগ করে এগিয়ে যেতে চান আরও বহুদূর। আরএএস ও বায়োফ্লক নিয়ে চলছে নানান গবেষণা। প্রযুক্তির কৃষিতে সাফল্য যেমন আছে, তেমনি আছে বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তাই বুঝেশুনেই বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের শিক্ষিত তরুণদের জন্য প্রযুক্তির কৃষি হতে পারে স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপম ও দারুণ কাজের ক্ষেত্র।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। shykhs@gmail.com